۵ آذر ۱۴۰۳ |۲۳ جمادی‌الاول ۱۴۴۶ | Nov 25, 2024
এই তালেবান ও সেই তালেবান- প্রার্থক্য কোথায়?
এই তালেবান ও সেই তালেবান- প্রার্থক্য কোথায়?

হাওজা / আফগানিস্তান এমন একটি দেশ, যাকে বলা হয় ‘সম্রাটদের কবরস্থান।

হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, আফগানিস্তান এমন একটি দেশ, যাকে বলা হয় ‘সম্রাটদের কবরস্থান। ইতিহাস বলে তাদের সাময়িকভাবে কব্জা করা গেছে কিন্তু সব দখলদারকে শেষ পর্যন্ত পালাতে হয়েছে। সবাই তাদের সভ্যতার ছোঁয়া, শিক্ষা দিতে গেছে, কিন্তু আফগানরা তাদের মতোই আছে। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশরা গিয়েছিল আফগানিস্তান দখল করতে, ১৯৭৮ সালে ফ্রেন্ডশিপ চুক্তির আড়ালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিল আফগানিস্তানে এবং ২০০১ সালে ‘ওয়ার অন টেরর’ নামে আমেরিকা গিয়েছিল– সবাইকে একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে।

সাবেক সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ, যিনি ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে তাঁর সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করেছিলেন, বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সেনা অভিযান চালিয়ে ভুল করেছিল। সে সময়ও রাশিয়াসহ পুরো পশ্চিমা জোট এই আগ্রাসন সমর্থন করেছিল।

ইতিহাসের কৌতুক হলো গত শতকের আশির দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আফগান মুজাহিদকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সমর্থন জুগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান ছিল তার প্রধান বরকন্দাজ। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের আগপর্যন্ত তাদের সে সমর্থন অব্যাহত ছিল। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনায় আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের যুক্ত থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে অভিযান চালায় এবং পরবর্তীকালে মার্কিন সেনারা পাকিস্তানে কমান্ডো হামলা চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে। সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে বর্তমান তালেবান শাসনের দায় বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তিটি এড়াতে পারে না। মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন-সমর্থিত ২০ বছরের শাসনকাঠামো তাসের ঘরের মতো উড়ে গেল। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালালেন।

এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো জনগণের সমর্থন না থাকলে কোনো পরাশক্তি কোনো দেশে দখলদারি টিকিয়ে রাখতে পারে না।

এখন প্রশ্ন হলো আমেরিকান দখলদারি-উত্তর আফগানিস্তানের শাসনকাঠামো কেমন হবে? সেখানে কি ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন সরকারের মতো কট্টর কোনো শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হবে? এ ভয় থেকেই ১৫ আগস্ট হাজার হাজার মানুষ দেশত্যাগের জন্য বিমানবন্দরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। এ ভয় থেকেই সীমান্ত পেরিয়ে অনেকে পাকিস্তান, কিরগিজস্তান ও ইরানে আশ্রয় নিয়েছে।

এখন পর্যন্ত যেসব খর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে গত ২০ বছরে আমেরিকা না বদলালেও তালেবান নিজেকে বদলে নিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। এর প্রমাণ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে দোহায় কয়েক মাস ধরে সফল আলোচনা। তালেবান কৌশলে এ আলোচনায় আশরাফ গনি সরকারকে বাইরে রেখেছে, কাবুলে আসার অনেক আগেই তারা ইরান, চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা দেখিয়েছে।

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তাদের নীতি-পরিকল্পনা কী হবে, সেসব নিয়েও দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক আলোচনা আছে। এই তালেবান আশার সম্ভাবনাও যেমন আছে, তেমন আছে আছে সংশয়ও।

গত ১৪ আগস্ট, তালেবান কাবুলের দখল নেয়ার আগের দিন; আফগানিস্তানে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা এক বাংলাদেশি তার পরিবারের সঙ্গে আলাপে তাঁকে হতবিহ্বল মনে হয়েছিল, দেশে ফেরার টিকিট কাটার জন্য মরিয়া চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পরদিনই নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, কাবুলে সবকিছু এখন স্বাভাবিক। অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা। তালেবান নেতারা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গিয়ে কর্মকর্তাদের অভয় দিচ্ছেন, তাঁরা যেন তাদের দায়িত্ব পালন করে যান; বিশেষ করে নারী কর্মীদের।

তালেবান সম্পর্কে ধারাবাহিক বিষোদগার করা ভারতীয় মিডিয়াকে ভরকে দিয়েছে সদ্য আফগানিস্তানের কাবুল ফেরত ভারতীয় শিক্ষক! কাবুলে শিক্ষকতার পেশায় কর্মরত থাকা তমাল ভট্টাচার্যের বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। তিনি জানান, 'তালেবানরা তাদের কোনও ক্ষতি করা তো দূরের কথা অতিথিসুলভ ব্যবহার করেছে। আমাদেরকে খাবার, ওষুধ, জল সব দিয়েছে। আমাদের যাতে কেউ ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে দায়িত্ব নিয়ে নজর দিয়েছে। ওদের কাছে কিন্তু আমরা অতিথি ছিলাম। সেভাবেই ব্যবহার করেছে আমাদের সঙ্গে।'

ওই সংবাদ সম্মেলনে তমাল ভট্টাচার্য আশরাফ গনি সরকারকেও একহাত নেন। তিনি বলেন, 'গনি সরকার ও তালেবান সরকারের মধ্যে ব্যবহারে পার্থক্য রয়েছে। তালেবান সরকার আশরাফ গনি সরকারের চেয়ে ভালো হতে পারে।'

বাংলাদেশি ও ভারতীয় দুই আফগান প্রবাসীর কথার সমর্থন পাওয়া গেল গত মঙ্গলবার কাবুলে তালেবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, নারীদের পড়াশোনা ও কাজের সুযোগ দেওয়া হবে। ইসলামি অনুশাসন অনুযায়ী মেয়েদের হিজাব পরতে হবে। তবে বোরকা বাধ্যতামূলক নয়। তাঁদের সরকার পরিচালিত হবে ইসলামি মূল্যবোধে। সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা সংঘাতের পুনরাবৃত্তি চাই না, আর যুদ্ধ চাই না। শত্রুতা শেষ হয়েছে। আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই। দেশের ভেতর ও বাইরে কোনো শত্রু চাই না।’ দেশে পশ্চিমা-সমর্থিত সরকারের সদস্য ও আফগান বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না ঘোষণা দিয়ে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। কেউ আপনার ক্ষতি করবে না। কেউ আপনার দরজায় কড়া নাড়বে না।’

তালেবানের ভবিষ্যৎ শাসন নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে যেসব প্রশ্ন ও সংশয় আছে, তার অনেকগুলোর জবাব দিয়েছেন জাবিউল্লাহ মুজাহিদ।

প্রশ্ন ছিল, ২০ বছর আগের তালেবানের সঙ্গে বর্তমান তালেবানের তফাত কী, জবাবে তিনি বলেন, মতাদর্শ ও বিশ্বাসের দিক দিয়ে কোনো তফাত নেই। যদি অভিজ্ঞতা, পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার কথা বলেন, নিঃসন্দেহে অনেক তফাত আছে। অতীতের থেকে এখনকার অবস্থান ভিন্ন হবে।

তালেবান মুখপাত্র বলেন, বেসরকারি সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। তবে সংবাদমাধ্যমের তালেবানের বিরুদ্ধে কাজ করা উচিত হবে না। আফগানিস্তানে আফিম চাষ বন্ধ করে দেশকে মাদকমুক্ত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তাও চান এই মুখপাত্র।

এখন প্রশ্ন হলো তালেবান সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া এসব প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করতে পারবে। তালেবান নেতৃত্ব কাঠামো পুরোপুরি খেলাফতভিত্তিক। তারা আফগানিস্তানকে আমিরাত হিসেবে প্রতিষ্ঠান করতে চায়। সেটি তাদের রাজনৈতিক দর্শন। কিন্তু সেই দর্শনের সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর সম্পর্কটি কী হবে? ইসলামি রাষ্ট্রের যেসব মডেল আছে, যেমন: ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক, এদের এক মডেলের সঙ্গে অন্য মডেলের ফারাক আছে। তালেবান আফগানিস্তানকে আমিরাত ঘোষণা করেছে। সেখানে আমিরই নির্বাহী প্রধান হওয়ার কথা। তাহলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী পদ, পার্লামেন্ট থাকবে কি না, সে প্রশ্নও আছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো বহু জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত আফগানিস্তানকে তালেবান সবাইকে নিয়ে দেশ শাসন করতে পারবে কি না। সোভিয়েত দখলদারির অবসানের পর মুজাহিদদের মধ্যে গোষ্ঠীগত সংঘাত এত বেড়ে গিয়েছিল যে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবান পুরো আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারেনি।

বর্তমান তালেবান নেতৃত্বের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সব জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিবেশী সব দেশ ও আঞ্চলিক শক্তির সমর্থন আদায় করা। তালেবান মুখপাত্র যে বলেছেন, তাঁরা অন্য দেশের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না, অন্য দেশের কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালনও করবে না, তাদের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে তার যথাযথ প্রতিফলন থাকতে হবে। প্রতিবেশীসহ আঞ্চলিক সব শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, বিদেশি সেনার দখলে থাকা আফগানিস্তানে তালেবানের জন্য জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা যত জরুরি ছিল, বিদেশি সেনার দখলমুক্ত আফগানিস্তানে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। তালেবানের জন্য তৃতীয় ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে তালেবান থেকে আল-কায়েদাকে আলাদা করা।তাদের জন্য এটা করা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, এদের মাঝে অনেক অভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে, যেটি নেতারা চাইলেও পুরোপুরি ছাড়তে পারবেন না। এদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে সীমান্তের ওপারের পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠীর, যাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। তাছাড়া ভৌগোলিক কারণে আফগানিস্তানের মতো একটা বিশাল, বিস্তৃত পাহাড়ি দেশে তালেবান সরকার আল-কায়েদাকে দমিয়ে রাখতে পারবে– এটাও বলা কঠিন।

যাহোক, আমার ধারণা তালেবান নেতৃত্ব হয়তো তাদের অতীতের ভুল হতে শিক্ষা নেবে। যদি তারা ক্ষমতার স্থায়িত্ব চায়, বৈধভাবে কাবুলে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক শক্তিকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তালেবান নেতাদের মধ্যে যারা বিচক্ষণ, বিশেষ করে যারা দোহায় শান্তি আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকে বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন, তারা বিশ্বে একঘরে হয়ে থাকতে চাইবেন না। তালেবানের সরকার গঠনে সদ্য ঘোষিত প্রতিশ্রুতিতেও সে ইঙ্গিত স্পষ্ট [আমরা অন্য একটি ভিডিওতে তাদের ১০ প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করেছি! কেউ দেখতে চাইলে কমেন্ট লিংকে গিয়ে দেখে নিতে পারেন]। তালেবানের প্রতিশ্রুতিতে ভরসা করে আমরা শান্তিশীল, উন্নত ও সমৃদ্ধ  আফগানিস্তান দেখার আশা করতেই পারি।

লেখাঃ রাসেল আহমেদ রিজভী

تبصرہ ارسال

You are replying to: .